গুরুদেব যে বিশেষ পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত, তাকে বলা হয় তার সম্প্রদায়। পদ্মপুরাণে সম্প্রদায় সম্পর্কে বলা হয়েছে-
সম্প্রদায়বিহীনা যে মন্ত্রান্তে নিস্ফলা মতাঃ।
অতঃকলৌ ভবিষ্যন্তি চত্বারঃ সম্প্রদায়িনঃ।।
শ্রীব্রহ্ম রুদ্র সনক বৈষ্ণব ক্ষিতিপাবন।
চত্বারস্তে কলৌ ভব্য হি উৎকলে পুরুষোত্তম।।
অর্থাৎ “ যে ব্যক্তি যথার্থ সম্প্রদায় বা গুরু-পরম্পরা হতে বিযুক্ত, সে যে মন্ত্রই জপ করুক না কেন, তা নিষ্ফল হয়। অতএব কলিযুগে চারটি বৈষ্ণব সম্প্রদায় অবির্ভূত হবেন। জগতের পবিত্রতা সম্পাদনকারী বিষ্ণুভক্ত শ্রী, ব্রহ্ম, রুদ্র ও সনক- এই কলিযুগে চারটি সম্প্রদায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে অথবা উৎকল দেশ পুরুষোত্তম শ্রীজগন্নাথ-ক্ষেত্র হতে আবির্ভূত হবে।” পদ্মপুরাণের এ উক্তি থেকে বোঝা যায় যে, আমাদের অবশ্যই কোনো না কোনো সম্প্রদায়ের আশ্রয়ে থাকা উচিত।
ভগবান বিভিন্ন সময় তাঁর ভক্তকে আবির্ভূত করিয়ে একেক সম্প্রদায়ের আচার্যরূপে অধিষ্ঠিত করে বৈদিক জ্ঞানের ধারা প্রবাহিত করেন। একেকটি সম্প্রদায়ে একেকজন মুখ্য আচার্য থাকেন, যাঁর শিক্ষা, আদর্শ বা নীতিসমূহ তাঁর অধস্তন বা উত্তরসূরিরা পালন করে থাকেন। পদ্মপুরাণের উপরোক্ত শ্লোকটির পরবর্তী শ্লোকে বলা হয়েছে-
রামানুজং শ্রীঃ স্বীচক্রে মধ্বাচার্যং চতুর্মুখঃ।
শ্রীবিষ্ণুস্বামীনং রুদ্রো নিম্বাদিত্যং চতুঃসনঃ।।
অর্থাৎ “উক্ত চারটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষ্ণুশক্তি লক্ষ্মীদেবী রামানুজকে, বিষ্ণুপুত্র ব্রহ্মা মধ্বাচার্যকে, বিষ্ণুসখা রুদ্র শ্রীবিষ্ণুস্বামীকে এবং বিষ্ণুপৌত্র চতুঃসন অর্থাৎ সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার নিম্বার্ককে নিজ নিজ সম্প্রদায় প্রবর্তকরূপে স্বীকার করবেন।” এ চার সম্প্রদায়-আচার্যের মাধমে কলিযুগে বৈদিক জ্ঞান প্রবাহিত হয়েছে। যথাঃ
১. রামানুজাচার্য (শ্রী সম্প্রদায়)
২. মধ্বাচার্য (ব্রহ্ম সম্প্রদায়)
৩. বিষ্ণুস্বামী (রুদ্র সম্প্রদায়)
৪. নিম্বার্কাচার্য (কুমার সম্প্রদায়)
এ চার সম্প্রদায় হচ্ছে ভগবৎপ্রদত্ত বৈদিক জ্ঞান বিতরণের অনুমোদিত ও প্রামাণিক সংস্থা, যেখান থেকে নির্ভেজাল ও অবিকৃতভাবে সে জ্ঞান প্রদান করা হয়ে থাকে। এ জ্ঞানের উৎস পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং- যিনি সবরকম ত্রুটি, ভ্রান্তি ও অপূর্ণতার অতীত। নিম্নে এ চার সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলোঃ
রামানুজাচার্যঃ শ্রী সম্প্রদায়ের প্রধান আচার্য শ্রীরামানুচার্য আনুমানিক ৯৩৮ শকাব্দে আবির্ভূত হন। তিনি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে এ সম্প্রদায়ের প্রভাব লক্ষনীয়। রামানুজ সম্প্রদায়ের বিশেষ তিলক রয়েছে। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ অনুসারে জীব ও জগৎ সগুণ ব্রহ্ম ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। জীব বদ্ধও হতে পারে আবার মুক্তও হতে পারে। জগৎ যদিও প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত হয়, তবুও জগৎ সত্য এবং নিত্য। বদ্ধজীবের স্বরূপ অজ্ঞতার দ্বারা আচ্ছান্ন, কিন্তু মুক্ত অবস্থায় জীব বৈকুণ্ঠে ভগবৎসেবায় যুক্ত থাকে। পার্থক্য কেবল ভগবানের প্রতি শরণাগতির। ঈশ্বর পাঁচ স্বরূপে প্রকাশিতঃ ১. পর, ২. ব্যুহ, ৩. বিভব, ৪. অন্তর্যামী ও ৫. অর্চাবতার। শ্রীরামানুজাচার্য বেদার্থ সংগ্রহ, বেদান্ত সূত্রের শ্রীভাষ্য, ভগবদ্গীতা ভাষ্য, বেদান্ত সার, বেদান্ত দীপ, নিত্যগ্রন্থ ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি শ্রী-বৈষ্ণবদের জন্য ৭৪টি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ৭০০ সন্ন্যাসী, ১২০০০ ব্রহ্মচারী এবং হাজার হাজার গৃহস্থ শিষ্য ছিল।
নিম্বার্কঃ কুমার সম্প্রদায়ের প্রধান আচার্য শ্রীনিম্বার্ক ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হন। তিনি দ্বৈতাদ্বৈতবাদ দর্শন প্রচার করেন। তিনি বলেন যে, তিনি নারদ মুনির শিষ্য এবং তার জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময় তিনি নৈমিষারণ্যে অতিবাহিত করেছেন। শ্রীনিম্বার্কাচার্য শ্রুতিকে স্বতঃপ্রমাণ বলে স্বীকার করেন। শ্রুতির অনুগত শাস্ত্রও প্রমাণ বলে গৃহীত। চতুঃসন নারদমুনিকে ছান্দোগ্য উপনিষদের সপ্তম প্রপাঠকে যে উপদেশ প্রদান করেছেন, তা-ই শ্রৌত পরম্পরায় নারদের কাছ থেকে পেয়ে নিম্বার্কাচার্য জগতে প্রচার করেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে সকল বস্তুই ব্রহ্মাত্মক। বেদবিদগণের সিদ্ধান্ত এই যে, ব্রহ্মরূপ সদ্বস্তু থেকে অসদ্বস্তুর উদয় হতে পারে না। বস্তুবিজ্ঞানই সকল বস্তুর যথার্থ তত্ত্ব। তা শ্রুতি ও স্মৃতি থেকে জানা যায়। কোনো স্থানে দ্বৈত এবং কোনো স্থানে উভয়নিষ্ঠ বাক্য প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং কেবল অদ্বৈতবাদ স্থান পায় না। শ্রুতি ও সূত্র বিচারে অদ্বৈত ও দ্বৈত উভয়ই সিদ্ধ হওয়ায় দ্বৈতাদ্বৈতবাদ শাস্ত্রানুসারে গ্রহণীয়। শ্রীনিম্বার্ক আচার্যের রচনাসমূহের মধ্যে বেদ ও উপনিষদের ভাষ্য, বেদান্ত পারিজাত সৌরভ, সদাচার প্রকাশ, গীতা ভাষ্য, রহস্য ষোড়শী, কৃষ্ণ স্তব রজ, প্রপন্ন কলাপ বল্লী ও প্রাতঃস্মরণ অন্যতম।
বিষ্ণুস্বামীঃ বিষ্ণুস্বামী রুদ্র সম্প্রদায়ের আচার্য। তিনি শুদ্ধাদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। পরবর্তীকালে অদ্বয়জ্ঞান বিরোধী বিদ্ধ মতবাদ প্রচারিত হলে সাত্বত আচার্যগণ শ্রীবিষ্ণুস্বামীর সিদ্ধান্তকে ‘শুদ্ধাদ্বৈতবাদ’ এবং মায়াবাদীগনের বিদ্ধ মতবাদকে ‘কেবলাদ্বৈতবাদ’ বলে আখ্যা প্রদান করেন। শুদ্ধাদ্বৈতবাদ মতে, বস্তুর অংশ জীব, বস্তুর শক্তি মায়া, বস্তুর কার্য জগৎ, এরা সকলেই বস্তু পদবাচ্য, কেউ বস্তু থেকে পৃথক নয়। শ্রীবিষ্ণুস্বামী রুদ্রের আনুগত্যে নৃপঞ্চাসের উপাসক। বর্তমানে বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায় লুপ্তপ্রায়। শ্রীবিষ্ণুস্বামীর সর্বজ্ঞ সূত্রের প্রচারও বিরল। ভাগবত পুরাণের বিখ্যাত ভাষ্যকার শ্রীপাদ শ্রীধর স্বামী বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।
মধ্বাচার্যঃ মধ্বাচার্য ব্রহ্ম সম্প্রদায়ের অন্যতম আচার্য। তিনি ১০৪০ শকাব্দে, মতান্তরে ১১৬০ শকাব্দে আবির্ভুত হন। মাধ্ব সম্প্রদায়ের কেন্দ্র ছিল উড়ুপিতে। মধ্বাচার্য দ্বৈতবাদ বা বিশিষ্ট দ্বৈতবাদ প্রচার করেন। এ সিদ্ধান্ত অনুসারে ঈশ্বর, জীব এবং জগৎ পরস্পর ভিন্ন। ঈশ্বর সর্বদাই স্বতন্ত্র, আর জীব, প্রকৃতি, কাল, কর্ম ইত্যাদি সবই পরতন্ত্র। এই ভিন্নতাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১. জীব ও ঈশ্বরের ভেদ, ২. জীবে-জীবে পরস্পর ভেদ, ৩. ঈশ্বর ও জড়ে ভেদ, ৪. জীবে জড়ে ভেদ, ৫. জড়ে জড়ে পরস্পর ভেদ। যদিও জগৎ কখনো ব্যক্ত আবার কখনো অব্যক্ত অবস্থায় থাকে, তবুও এ পাঁচ প্রকার ভেদ সত্য। জীবসকলকেও আবার গুণের ভিত্তিতে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে- সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। সর্বমূল বলে কথিত মাধ্বাচার্যের ৩৭ টি গ্রন্থ চার ভাগে বিভক্ত- ১. প্রস্থান ত্রয়, ২. দশ প্রকরণ, ৩. স্মৃতি প্রস্থান, ৪. রীতিনীতি এবং সন্ন্যাস বিষয়ক প্রবন্ধ ও কবিতাবলি।
অজানা অনেক কিছু জানতে পারলাম। আপনার তাৎপর্য পূর্ণ সনাতন ধর্মের নিয়মানুবর্তীতার ও পরম্পরা গত দীক্ষা সম্পর্কে জানতে পারলাম।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অনেক সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশন করার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ অজানা অনেক কিছু জানতে পারলাম 🙏🙏🙏